কবিতা বুঝে ফেলা নারী আর কবিতা নিয়ে একসঙ্গে ঘর করা যায় না!
ভার্সিটির প্রথম বর্ষের শেষের দিকে বড়লোক ঘরের এক আহ্লাদী মেয়ের সাথে পরিচয় ঘটলো। যেকোনো কথা শুনলেই তাতে গদগদ হয়ে হাসে। একদিন বললাম, আহ্লাদী মেয়ে আমার কাছে অতটা পছন্দের বস্তু না। মেয়ে মানুষকে বস্তু বলাতে আহ্লাদী মেয়েটার ইগোতে গিয়ে লাগলো। সে তখন নারীদের সন্মান কিভাবে দিতে হয় সেই সম্পর্কে মহামূল্যবান কিছু কথা বলেছিলো। তবে দমে না গিয়ে শেষমেষ মেয়েরা যে এক ধরণের বস্তু সেই কথাতেই স্থির থাকলাম। স্যাম্প্যু সোডার বিজ্ঞাপণে চুলের বদলে মেয়েদের জিরো ফিগার দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত হয়ে মেয়েদের বস্তু না মানতে নারাজ।
সেইদিনের পর থেকে আহ্লাদ কিছুটা কমে গিয়েছিলো। ছেলে মেয়েদের মধ্যে অলিখিত একটা নিয়ম হচ্ছে, ঝগড়ার মাধ্যমে বন্ধুত্ব থেকে গাড় বন্ধুত্ব হওয়া কিংবা প্রেম-ট্রেম হওয়া। এই আওতা থেকে আগামী তিন প্রজন্ম বের হতে পারবে না বলে আমার চুড়ান্ত বিশ্বাস। আওতাধীন নিয়মের মধ্যে পড়ে আমরা হয়ে গেলাম ভালো বন্ধু।
শায়লা জিন্স টিন্স পড়ে ভার্সিটিতে যাতায়ত করে। বড়লোক ঘরের মেয়েদের জিন্স আর শার্টে কিভাবে যেনো মানিয়ে যায়। আসল কথা হচ্ছে, চিকনা-চাকনা সুন্দরী যেকোনো মেয়েদেরকেই জিন্সে মানিয়ে যায়। গরিব ঘরের মেয়েদেরও মানাবে, তবে জিন্স-শার্ট পড়ার পরে গরীব ঘরের মেয়েরা এক প্রকার অস্বস্তিতে ভুগে সেই অস্বস্তিতের কারণে আসল সৌন্দর্যটা গোধূলীর সূর্যের উপর এক টুকরো মেজাজ গরম করা মেঘ হয়ে যায়। মেয়ে দেখতে সুন্দর, অস্বস্তিতে আর সৌন্দর্যটা টের পাওয়া যায় না।
আমি ভার্সিটির কোনায় বসে একটা বেনসন ধরিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে সিগারেট টানছি। এমন সময় শায়লা এসে পাশে বসে বললো, তোমাকে দেখতে ক্ষ্যাতের মত দেখা যাচ্ছে। বুড়ো মানুষের মত সাদা লম্বা পাঞ্জাবি পরে কেউ ভার্সিটিতে আসে?
আমি আরো আয়েশি ভঙ্গিতে সিগারেটে দুটো টান দিলাম। বললাম, কবিরা আসে। একালের কবিদের পোশাক হচ্ছে লম্বা সাদা পাঞ্জাবী আর সাথে আধোয়া একটা জিন্স প্যান্ট। একমাস তিনদিন ধরে প্যান্টটা ধোয়া হচ্ছে না।
‘তুমি কি জানো? একাধারে তুমি ক্ষ্যাত সাথে খবিশ। তোমার প্যান্ট থেকে গন্ধ বের হচ্ছে’।
কথাটা মিথ্যা। যেইদিন থেকে এই প্যান্টটা পরতে শুরু করেছিলাম সেদিন নিউমার্কেটে গিয়ে অতি সস্তায় একটা জগতবিখ্যাত ফ্রেন্স পারফিউম কিনে এনেছিলাম। ফ্রান্সের টিউলিপ ফুলের বাগান থেকে প্রাকৃতিক ফুলের নির্যাস দিয়ে এই পারফিউম বানানো হয়েছে। কেনার সময় বব্বুল আলামীনের কসম দিয়ে দোকানি আমাকে কথাটা বলেছিলো। তাই বিশ্বাস করে শুধুমাত্র জিন্সপ্যান্টে দেওয়ার জন্য কিনে এনেছি। সুতরাং আমার প্যান্ট থেকে টিউলিপ ফুলের গন্ধ বের হওয়ার কথা, দুর্গন্ধ কোনোভাবেই না।
‘মিথ্যা কথা বলিও না। মিথ্যা পাপের বাবা। পাপের মায়ের সাথে তুমি ঘোরাঘুরি করতে থাকলে অনেক বাচ্চাকাচ্চা জন্ম নিয়ে পাপ ছড়াবে। প্যান্ট থেকে টিউলিপ ফুলের গন্ধ বের হচ্ছে। তাও যেনো তেনো টিউলিপ ফুল না। ফ্রান্সের অগ্যতা কোনো টিউলিপ ফুল বাগানের ফুলের গন্ধ’।
কবিরা নিজে নিজে মনে করে তাদের গুণের কোনো শেষ নেই। অন্য মানুষ দেখতে গেলে শুধু কবিতাটকে গুণের মধ্যে রাখে, তাও সব মানুষ না। ভয়াবহ একটা ব্যাপার হচ্ছে, আজকাল দেশের বিশ ভাগের একভাগ মানুষ কবিতা পড়ে না। গুন-বেগুণ তো জানাশোনার বাইরে। হতাশার ব্যাপার। কবিদের বড় দোষ হচ্ছে বানিয়ে বানিয়ে কথা বলা। বানিয়ে বানিয়ে কথা না বললে তো কবিতা লেখা হয় না। জীবনান্দের ‘বনলতা সেন’ কবিতা পড়ে যুবসমাজ অস্থিরতার পথে। অস্থির হয়ে ‘বনলতা সেন’ খুজতে খুজতে ক্লান্ত হয়ে শেষমেশ খালাতো বোন শেফালীকে বিয়ে করে ফেলে। খোজ নিয়ে দেখা যাবে, বনলতা সেন দেখতে আদতে এত সুন্দর না। কবি কৃপা করে বানিয়ে বানিয়ে বলে সৌন্দর্যটাকে স্বর্গের হুরের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। বনলতার সৌন্দর্য নাকি কবিদের বানিয়ে বানিয়ে লেখা কবিতা কোনটা সুন্দর?
টিউলিপের গন্ধ বানিয়ে বানিয়ে বলেছি, এই অপবাদ দেওয়াতে আমি জীবনান্দকে টেনে এনে ‘বনলতা সেন’-এর কথা শুনিয়ে দিলাম। সাথে পারফিউম কেনার কাহিনী। তাও নাকি সব বানানো কথাবার্তা। আমি প্রতিবাদ করলাম না। কারণ ততক্ষণে শায়লা আমাকে বলে দিয়েছে, এই ধরণের বানানো কথাবার্তা শুনতে ওর অতি ভালো লাগে। অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ, অতি ভালোলাগা প্রেমের লক্ষণ।
শায়লা আমার প্রেমে পড়েছে। অতি রূপবতী কাউকে আমার প্রেমিকা হিসেবে পছন্দ না। রূপবতীদের রূপ আলাদা করে বর্ণনা করার কিছু নেই। কবিদের চোখ পড়বে সাদামাটা কোনো এক নারীর প্রতি। বানিয়ে বানিয়ে বলে সেই সাদামাটা মেয়েটা একদিন রূপবতীদের থেকেও রূপবতী হয়ে উঠবে। শায়লার এখন নিয়ম করে আমার বানিয়ে বলা মিথ্যা শুনতে হয়। বিনিময়ে মেসে থাকা কবিকে একবেলা দাওয়াত দিয়ে বাসার রান্না খাইয়ে দিবে। নিজ হাতে খাইয়ে দিবে এই আশা কবিরা করে না। এসব করে আহ্লাদী মেয়েরা। আহ্লাদী মেয়েদের নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো কবি কবিতা লেখেনি। আমি যদি শায়লাকে নিয়ে কবিতা লেখি তাহলে কবিদের মান ইজ্জত বলে কিছু থাকবে না।
আজ দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য শায়লাদের অট্টালিকার দিকে যাচ্ছি। এখনকার কবিদের ওয়্যারড্রব ভর্তি ধোয়া জামাকাপড় থাকে সর্বদা, বেশ ধরার জন্য সেই আধোয়া জিন্সটাই দরকার পড়ে। প্রথমবার কোনো নারীর দাওয়াতে নারীর বাসায় গেলে হাতে করে একটা কিংবা দুইটা ফুল নিয়ে যেতে হয়। ফুটন্ত ফুল নিলে হবে না। ফুটন্ত ফুল হচ্ছে প্রেমিক প্রেমিকাদের বস্তু। যেসকল মানুষ ফুল না নিয়ে যায়, তারা কখনো কবিতা পড়েনি। তাদের জীবন অতিশয় বৃথা। আমি বৃথা জীবন নিয়ে শায়লাদের বাসায় হাজির হলাম। পুরোপুরি বৃথা বলা যাবে না। একটা কিংবা দু’টো ফুলের বদলে আমি আজো পুরো টিউলিপ বাগান নিয়ে হাজির হয়েছি।
কবিদের ক্ষুধা বেশি। শরীরের খিদা এবং মনের খিদা দুটোই।
কবিদের ক্ষুধা বেশি। শরীরের খিদা এবং মনের খিদা দুটোই।
আজকালকার মানুষের চিন্তাভাবনা অবনতির দিকে। শরীরের ক্ষুধা শুনলেই মানুষ মনে করে যেই ক্ষুধা শরীর দিয়ে মেটানো হয় সেটাই হচ্ছে শরীরের ক্ষুধা। পেটের ক্ষুধাই হচ্ছে আসল শরীরের ক্ষুধা। আমি শরীরের ক্ষুধার কথা বলে শায়লা’কে একটু ভড়কে দিয়ে বললাম, ক্ষুধায় পেট পাকিয়ে যাচ্ছে। কবির সন্মার্থে আজকে বাসায় কবির পছন্দমত খাবার রান্না হয়েছে। অতি পাতলা করে ডাল আর ঘি দিয়ে আলুভর্তা।
শায়লা জিজ্ঞেস করেছিলো, বাসায় এসে কি খেতে চাও?
শায়লা জিজ্ঞেস করেছিলো, বাসায় এসে কি খেতে চাও?
বলেছিলাম, ‘পাতলা ডাল। কুমারী নদীর পানির মত পাতলা ডাল হতে হবে। ডালের উপর যেনো আমি অনায়াসে সাতার কাটতে পারি, সাথে আলুভর্তা। কুচি কুচি করে বেশি তেল আর পেয়াজ দিয়ে আলুভাজি’।
আলুভাজির ব্যবস্থাও হয়েছে। আমি ক্ষনিকক্ষণ ডালের উপর সাতার কাটলাম। এরপর খাওয়া শেষ করে শায়লার রুমে বসে বানিয়ে বানিয়ে কথা বলার প্রস্তুতি নিলাম।
শায়লা বললো, ‘কবিরা কি বিয়ে করে?’
‘কবিরা আলবৎ বিয়ে করে। বিয়ে না করে অমর কবি হওয়া সম্ভব না। সব অমর কবিরা বিয়ে করেছেন সাথে পরকীয়া করে জীবন প্রজ্জলিত করে কবিতা লিখেছেন’।
‘আমার সামনে থাকা কবি কেমন মেয়ে বিয়ে করতে চায়?’
কবিদের জিজ্ঞেস করে এই উত্তর পাওয়ার আশা বৃথা। কবিরা এমন কাউকে কখনো বিয়ে করতে চায় না, যে মানুষ কবিতা পড়ার সাথে সাথেই সবকিছু বুঝে ফেলবে। তাহলে কবিতা অর্থহীন হয়ে পড়ে। নারী আর কবিতা আলাদা কিছু নয়। কবিদের যেমন কবিতাকে ভালোবাসতে হয়, নারীদেরকেও ভালোবাসতে হয়। যেই নারী কবিদের কবিতা বুঝে ফেলে তারা সহজেই কবিদের প্রেমে পড়ে যায় আর কবি হারায় কবিতার মূল্য। দুইয়ে মিলে কবিতা না বোঝা মেয়েদেরকেই কবিদের পছন্দ।
শায়লা আমাকে কিছুক্ষণের জন্য ছাদে যেতে বলে বললো, সে আসছে। আমি ছাদের রেলিংয়ের কাছে গিয়ে শহরের দিকে চোখ বোলাতে বোলাতে মাথার মধ্যে দুপুরের খাবারের পর সিগারেট খাওয়ার তাৎপর্য নিয়ে দুই লাইন কবিতা লেখার চেষ্টা চালাচ্ছি। কারণ দুপুরের খাওয়ার পর সিগারেট খাওয়া হয়নি। দুধের স্বাধ ঘোলে মিটে, সিগারেটের স্বাদ কবিতায়। যখনই সিগারেট নিয়ে চার লাইন কবিতা লেখেছি তখন অবাক করে দিয়ে শায়লা শাড়ি পড়ে ছাদে এসে দাড়িয়েছে। কবিদের অত অবাক হতে নেই বলে সাদামাটা ভঙিতে বললাম, শাড়িতে তুমি এত সুন্দর কেনো?
‘কবিতা লেখার মত সুন্দর?’- বলে একটা সিগারেট আর লাইটার এনে আমার হাতে দিয়ে বললো, সকালে বাবার প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট সরিয়ে তোমার জন্য রেখে দিয়েছিলাম।
সিগারেট নিয়ে আমার অলেখা কবিতাটা শায়লা বুঝে ফেলেছে। আমি লাইটার দিয়ে সিগারেট জ্বালিয়ে বললাম, রূপবতীদের নিয়ে কবিরা কবিতা লেখে না। তুমি অসম্ভব রূপবতী। তারপরেও তোমাকে নিয়ে লেখা যায়, কারণ তোমাকে সাদামাটা দেখাচ্ছে।
‘আর বিয়ে করা যায় না?’
‘যায় না। তুমি আমার অলেখা কবিতার অর্থ বুঝে ফেলেছো। আমি কবিতা ভালোবাসি। কবিতা বুঝে ফেলা নারী আর কবিতা নিয়ে একসঙ্গে ঘর করা যায় না’।
#ডাকবাক্স
Comments
Post a Comment